👑হিমশীতল ঠাণ্ডা রাশিয়ার এক প্রাসাদে মোমবাতির আলো দুলছে। বরফ-ঢাকা জানালার ওপারে নিস্তব্ধ রাত, কিন্তু ভিতরে এক তরুণী হৃদয়ে ঝড় উথালপাথাল। তার নাম সোফিয়া—যিনি পরে ইতিহাসে অমর হলেন ক্যাথরিন দ্য গ্রেট নামে।
১৭২৯ সালের ২রা মে, প্রুশিয়ার (বর্তমান জার্মানির) শ্চেচিন শহরে এক ছোট অভিজাত পরিবারে জন্ম নেন সোফিয়া অগাস্টা ফ্রেডেরিকা। তার পিতা ছিলেন খ্যাতিহীন প্রুশিয়ান রাজপুত্র, আর মাতা জার্মান অভিজাত বংশের হলেও রাজনৈতিক প্রভাব ছিল সীমিত। শৈশব থেকেই সোফিয়া ছিলেন বুদ্ধিমতী, জ্ঞানপিপাসু ও অদম্য কৌতূহলী। কেউ ভাবেনি, এই সাধারণ পরিবারের কন্যাই একদিন রাশিয়ার অমর সম্রাজ্ঞী হয়ে ইতিহাসের পাতায় নাম লিখাবেন।
🌸 কৈশোরের সম্পর্ক: বিয়ের আগের আলোছায়া-
তরুণী সোফিয়ার সৌন্দর্য, প্রাণচাঞ্চল্য ও বুদ্ধিমত্তা আশপাশের তরুণদের আকৃষ্ট করত। বিয়ের আগেই তার জীবনে কয়েকজন পুরুষ সঙ্গী এসেছিলেন, যাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল আবেগঘন ও গোপনীয়। রাজকীয় সমাজে আনুষ্ঠানিকভাবে এই সম্পর্কগুলো গ্রহণযোগ্য ছিল না, তবু বাস্তবে তরুণদের মধ্যে এমন ঘনিষ্ঠতা অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। এই প্রাথমিক প্রেম-অভিজ্ঞতাগুলো দীর্ঘস্থায়ী হয়নি, তবে এগুলোই সোফিয়াকে জীবনের আবেগময় দিক চিনতে সাহায্য করেছিল। কৈশোরের সেই অভিজ্ঞতা তাকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল এবং ভবিষ্যতে নিজের আবেগকে স্বাধীনভাবে বেছে নেওয়ার সাহস জুগিয়েছিল।
💍 পিটারের সঙ্গে বিবাহ: শূন্যতার প্রাসাদ-
১৭৪৫ সালের আড়ম্বরপূর্ণ দিনে সোফিয়া পাড়ি দিলেন রাশিয়ার রাজধানীতে। অল্প বয়সে তার বিয়ে হলো রাশিয়ার উত্তরাধিকারী পিটার তৃতীয়ের সঙ্গে। রাজনীতি ও কূটচক্রের বাঁধন এই বিবাহকে প্রেমহীন করেছিল। পিটার ছিলেন শিশুসুলভ, অস্থির এবং রাজনৈতিকভাবে অক্ষম। স্বামীর অবহেলা আর প্রাসাদের নিঃসঙ্গ দেয়াল সোফিয়ার ভেতরে জন্ম দিল শূন্যতা, আর সেই শূন্যতার মধ্য দিয়েই ধীরে ধীরে গড়ে উঠল তার নতুন পরিচয়—ক্যাথরিন।
⚔️ ক্ষমতার খেলায় পিটারের পতন-
স্বামী পিটার তৃতীয় যখন রাশিয়ার সিংহাসনে আরোহণ করলেন, তখন তার শাসন দ্রুত অজনপ্রিয় হয়ে পড়ল। তিনি সেনাবাহিনীকে অবহেলা করলেন, অভিজাতদের অসন্তুষ্ট করলেন এবং নিজের খামখেয়ালি সিদ্ধান্তে রাশিয়াকে অস্থির করে তুললেন। এই সুযোগে ক্যাথরিন নিঃশব্দে সেনাবাহিনীর প্রভাবশালী অংশ এবং অভিজাত শ্রেণিকে নিজের পক্ষে আনলেন। তার প্রেমিক গ্রিগরি অরলভ ও তার ভাইরা সেনাদের নেতৃত্ব দিলেন বিদ্রোহে। এক প্রাসাদ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্যাথরিন ক্ষমতা দখল করলেন এবং পিটারকে সিংহাসনচ্যুত করে কারাগারে পাঠালেন। কিছুদিন পর রহস্যজনকভাবে পিটারের মৃত্যু ঘটে। এভাবেই এক অসহায় স্ত্রী রূপান্তরিত হলেন এক নির্ভীক সম্রাজ্ঞীতে।
❤️ সাল্টিকভ থেকে অরলভ: প্রেমের প্রথম আলোকরেখা-
প্রাসাদের অন্ধকারে হঠাৎ আলো হয়ে এলেন সার্জেই সাল্টিকভ। তার সঙ্গে ক্যাথরিনের প্রথম প্রেম গড়ে উঠল। এমনকি গুঞ্জন ছড়াল, তার পুত্র পল আসলে সাল্টিকভের সন্তান। তবে প্রেমের এই অধ্যায় দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। পরে জীবনে এলেন গ্রিগরি অরলভ, সাহসী সেনাপতি। তার ভালোবাসা ও শক্তি ক্যাথরিনকে সিংহাসনে বসাতে সাহায্য করল। প্রেম আর রাজনীতি এক অদ্ভুত বন্ধনে মিলেমিশে গেল।
🌹 পোতেমকিন: হৃদয়ের সম্রাট-
ক্যাথরিনের জীবনের প্রকৃত রূপকথা শুরু হয় গ্রিগরি পোতেমকিনকে ঘিরে। তিনি ছিলেন তার আত্মার সঙ্গী। কেউ কেউ বলেন, তারা গোপনে বিবাহ করেছিলেন। কৃষ্ণসাগরের তীরে নতুন শহর, সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ—সবখানেই ছিল তাদের যৌথ স্বপ্ন। পোতেমকিন শুধু প্রেমিকই নয়, ছিলেন সম্রাজ্ঞীর আস্থা ও হৃদয়ের সম্রাট।
🔥 আবেগ ও অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষা-
প্রাসাদের ঝলমলে কক্ষে, মোমবাতির আলোয় দীপ্ত এক সম্রাজ্ঞীর হৃদয়ে ছিল এক অদম্য আগুন। ক্যাথরিন দ্য গ্রেট ছিলেন শুধু ক্ষমতার রানি নন, ছিলেন আকাঙ্ক্ষারও সম্রাজ্ঞী। তার ভেতরে জন্মেছিল এমন এক অতৃপ্ত তৃষ্ণা, যা কেবল রাজনীতির সিংহাসনে নয়, ভালোবাসার বুকে পূর্ণতা খুঁজত। স্বামী পিটার ছিলেন শূন্যতার প্রতীক, আর সেই শূন্যতাই তাকে প্রেমের নতুন দরজায় ঠেলে দিয়েছিল। একের পর এক প্রেমিক, একের পর এক রোমান্টিক অধ্যায়—সব যেন তার আত্মাকে তৃপ্ত করার প্রচেষ্টা। সমালোচকেরা তাকে অতিরিক্ত কামনাময়ী আখ্যা দিলেও, তিনি ইতিহাসের চোখে এমন এক নারী, যিনি ভালোবাসা ও আকাঙ্ক্ষাকে নিজের জীবনের শক্তিতে রূপ দিয়েছিলেন।
🌙 শেষ জীবনের নিঃসঙ্গতা-
সময় বয়ে গেল, চুলে সাদা রঙ নেমে এল, কিন্তু ক্যাথরিনের হৃদয়ের আগুন নিভল না। জীবনের শেষ প্রান্তে তিনি পাশে রেখেছিলেন তরুণ প্রেমিকদের। প্রাসাদ, জমি, উপাধি—সবকিছুই বিলিয়ে দিতেন তাদের হাতে। সমালোচকরা বলেছিলেন বিলাসিতা, কিন্তু ইতিহাস জানে—এগুলো ছিল এক শক্তিশালী নারীর একাকীত্ব ঢাকার উপায়।
🏛️ প্রেম ও ক্ষমতার দ্বৈত সুর-
ক্যাথরিন কখনও ব্যক্তিগত প্রেম আর রাজনৈতিক দায়িত্বকে আলাদা করেননি। তার প্রেমিকদের মধ্যে থেকে তিনি খুঁজে নিয়েছেন যোগ্য সেনাপতি, দক্ষ প্রশাসক ও বিশ্বস্ত পরামর্শদাতা। ফলে তার রোমান্স কেবল ব্যক্তিগত আবেগ নয়, রাশিয়ার সাম্রাজ্যের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে।
🔚 সমাপ্তি: মানবিক সম্রাজ্ঞী-
ক্যাথরিন দ্য গ্রেটকে স্মরণ করা হয় এক অদম্য সম্রাজ্ঞী হিসেবে। তবে মুকুটের আড়ালে ছিলেন একজন নারী—যিনি ভালোবাসতে জানতেন, ভাঙতে জানতেন, আবার নতুন করে গড়তেও জানতেন। তার প্রেম, আকাঙ্ক্ষা ও আবেগ তাকে মানবিক করেছে। আর এই মানবিকতার মধ্য দিয়েই তিনি সত্যিকার অর্থে গ্রেট’হয়ে উঠেছেন।
#MRKR