সনাতনধর্মী বাঙালির একটি ঐতিহ্যবাহী ও রহস্যময় উৎসব হলো চড়ক পূজা। চড়ক পূজা কেবল একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি বাংলার লোকজ সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ। চৈত্র সংক্রান্তির দিনে পালিত এই উৎসব যেমন আধ্যাত্মিক নিষ্ঠা ও সাধনার প্রতীক, তেমনি এটি বাংলার গ্রামীণ সমাজে লোকউৎসব হিসেবে দীর্ঘকাল ধরে পালিত হয়ে আসছে।
ইতিহাস ও ধর্মীয় পটভূমি
চড়ক পূজার শিকড় প্রোথিত রয়েছে প্রাচীন শৈব ধর্মের উপাসনায়। লোকবিশ্বাস অনুসারে, এই পূজা শিব বা ধর্মঠাকুরকে উৎসর্গ করা হয়। শিব ত্যাগ, সহিষ্ণুতা ও ধ্বংসের দেবতা। চড়ক পূজার মাধ্যমে ভক্তরা শরীরের কষ্টের মধ্য দিয়ে পাপমোচন ও ঈশ্বরের কৃপা লাভের আশায় ব্রত পালন করে। বিশেষত গ্রামীণ কৃষিজীবী সমাজ প্রাকবর্ষায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পেতে, ফসলের মঙ্গল কামনায় এই পূজার আয়োজন করে।
চড়ক পূজার আচার
চড়ক পূজার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এক মাসব্যাপী ব্রত। ভক্তরা নিরামিষ আহার করেন, উপবাস করেন, এমনকি অনেক সময় পাঁজরে কাঁটা বিদ্ধ করে কষ্ট সহ্য করেন। পূজার দিন বড় একটি কাঠের খুঁটিতে (চড়ক গাছ) দড়ি দিয়ে বেঁধে ভক্তদের ঘুরানো হয়। কেউ কেউ কাঁটা বা শূল বিদ্ধ করে শূন্যে ঝুলে থাকেন—এই ভয়ঙ্কর তপস্যাকে ‘চড়ক খেলা’ বলা হয়। অনেকে আবার আগুনের ওপর হাঁটা, কাঁচের ওপর শোয়া বা মুখে ছুরি বিদ্ধ করার মতো কাজও করেন।
চড়ক পূজা শুধু একটি ধর্মীয় আচার নয়, বরং এটি হয়ে উঠেছে একটি বর্ণাঢ্য লোকোৎসব। পূজার চারপাশে বসে মেলা, চলে পুতুলনাচ, লাঠিখেলা, যাত্রাপালা, লোকগান ও নানা ধরনের হস্তশিল্পের দোকান। গ্রামীণ নারীরা নানা রকম পিঠাপুলি তৈরি করে বিক্রি করেন। মেলা হয়ে ওঠে স্থানীয় মানুষের আনন্দ, বিনোদন ও বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু।বাংলাদেশের খুলনা, বরিশাল, সাতক্ষীরা, যশোর, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া ও মাগুরা অঞ্চলে চড়ক পূজা বিশেষ জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালিত হয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান, নদীয়া, বীরভূম, উত্তর ২৪ পরগণাও এই উৎসবে বিশেষভাবে বিখ্যাত। কোথাও এটি ‘নীল পূজা’, আবার কোথাও ‘গাজন উৎসব’ নামেও পরিচিত।
আধুনিক রূপান্তর
বর্তমানে অনেক জায়গায় চড়ক পূজার শারীরিক নির্যাতনের দিকগুলো পরিহার করে প্রতীকী রূপে উদযাপন করা হয়। স্বাস্থ্যঝুঁকি ও মানবাধিকার সংক্রান্ত সচেতনতার কারণে চড়ক খেলা অনেক জায়গায় নিষিদ্ধ বা নিয়ন্ত্রিত। তবে উৎসবের বর্ণিলতা, লোকসংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিকতা আজও রয়ে গেছে।
No comments:
Post a Comment