Sunday, June 23, 2024

একজন শামসুল হক: বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের ট্র্যাজিক হিরো

১৯৩৯ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় করটিয়া সা’দত কলেজের ভিপি নির্বাচিত হন তিনি। তাঁর সময়কালে অন্যান্য বাঙালি মুসলিম যুবকের মতো তিনিও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে মুসলিম লীগের রাজনীতিতে যোগ দেন। ১৯৪৫ সালে আবুল হাশিম এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ঢাকায় মুসলিম লীগের আঞ্চলিক অফিস তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব দেন তাঁকে। তাঁর নেতৃত্বে পুর্ব বাংলায় মুসলিম লীগ সবচেয়ে প্রভাবশালী সংগঠনে পরিণত হয় এবং ১৯৪৬ সালে অবিভক্ত বাংলার নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে।

১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর মুসলিম লীগের রাজনীতি পশ্চাদমুখী যাত্রা শুরু করলে সমমনা প্রগতিশীল তরুণদের নিয়ে তিনি ১৯৪৭ সালের শেষ দিকে গণতান্ত্রিক যুবলীগ নামক সংগঠন গড়ে তোলেন। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পুর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি।

রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে গড়ে আন্দোলনে তিনি সামনের কাতারে থেকে নেতৃত্ব দেন।১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ধর্মঘটে পিকেটিং করার সময় গ্রেফতার হন। পূর্ববঙ্গের রাজনীতির ইতিহাসে বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি ১৯৪৯ সালের এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠিত টাঙ্গাইলের উপনির্বাচনে বিজয়ের কারণে। এই নির্বাচনে তিনি মুসলিম লীগ নেতা করটিয়ার জমিদার খুররম খান পন্নীর বিরুদ্ধে বিপুল ভোটে জয়ী হন। বলা হয় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দুই বছরের মাথায় মুসলিম লীগ সরকারের অপশাসনের জবাব দিয়েছিল টাঙ্গাইলের জনগণ।


ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্বদানের কারণে তিনি ১৯৫২ সালের ১৯ মার্চ গ্রেফতার হন। কারাজীবন দুর্বিষহ  নির্যাতনে তার শরীর ও মন উভয়ই খারাপ হতে থাকে এবং তিনি মানসিক রোগীতে পরিণত হন। ১৯৫৩ সালের ১৩ মার্চ তিনি মুক্ত হন। কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করে তিনি বাসায় ফিরে স্ত্রী ও সন্তানদের দেখতে না পেয়ে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে জানতে পারেন উচ্চ শিক্ষার জন্য সন্তানদের শ্বশুরবাড়িতে রেখে তাঁর স্ত্রী নিউজিল্যান্ড চলে গিয়েছেন। শ্বশুরবাড়িতে তিনি নিগৃহীত হয়ে মানসিকভাবে আরো ভেঙে পড়েন। তিনি দায়িত্ব গ্রহণে অসম্মতি জানিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে আওয়ামী মুসলিম লীগের সম্পাদক হিসেবে প্রস্তাব করেন এবং তাঁকে ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব দেয়া হয়।

১৯৫৪ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় যোগদানের এক সপ্তাহ পর তার উন্নত চিকিৎসার জন্যে করাচি মানসিক হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করেন। একসময় তাঁর মানসিক অসুস্থতা নিরাময় যোগ্য নয় বলে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেয়া হয়। মূলত ভাষা আন্দোলন ও সরকার বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে নিষ্ঠুর নির্যাতন ও সঠিক সময়ে চিকিৎসার অভাবে তিনি কারামুক্তির পর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেন নাই। আওয়ামী লীগের রাজনীতি থেকে ছিটকে গিয়ে তিনি আধ্যাত্মিকতায় ঝুঁকে পড়েন এবং খেলাফত পার্টি নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন বলে জানা যায়।

১৯৫৭ সালে তাঁর স্ত্রী দেশে ফিরে অসুস্থ স্বামীকে দেখতে যান এবং তাঁর রোগ অনিরাময়যোগ্য যোগ্য জানতে পেরে ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৫৯ সালে আফিয়া খাতুন পিএইচডি করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। পাঞ্জাবের বাসিন্দা আনোয়ার দিলের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে সেখানে, যাকে ১৯৬০ সালে বিয়ে করে অধ্যাপনা ও গবেষণা করে জীবন কাটান।

রাজনৈতিক ও ব্যক্তিজীবন বিপর্যয়ের শেষ সীমায় পৌঁছে তিনি ছন্নছাড়া, দুর্বিষহ, নিঃসঙ্গ জীবনে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে পথে পথে ঘুরতে থাকেন।  একসময় লোকচক্ষুর  অন্তরালে চলে যান তিনি। রোগাক্রান্ত শরীরে বিনা চিকিৎসা ও সেবাযত্নহীন অবস্থায় তিনি ১৯৬৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর পৃথিবী ছেড়ে চলে যান।

এভাবেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায়ের নির্মাতা শামসুল হকের জীবনের সমাপ্তি ঘটে।

No comments:

Istanbul: Capital of cats!

Istanbul is known  worldwide as the 'city of cats'. And it’s true; there are hundreds of thousands of stray cats in Istanbul, and m...