🧬 মানবদেহের কোষে থাকে মাইটোকন্ড্রিয়া নামে একটি ক্ষুদ্র শক্তির উৎস। এটি কোষকে প্রয়োজনীয় শক্তি সরবরাহ করে। কিন্তু কোনো নারীর মাইটোকন্ড্রিয়ায় যদি জিনগত মিউটেশন থাকে, তবে সন্তানদের মধ্যে সেই রোগ চলে যেতে পারে। যেহেতু নবজাতক পুরো মাইটোকন্ড্রিয়া কেবলমাত্র মায়ের কাছ থেকেই পায়, তাই একজন মায়ের মিউটেটেড মাইটোকন্ড্রিয়া ভবিষ্যতের প্রতিটি সন্তানকে আক্রান্ত করতে পারে।
প্রতি বছর সারা বিশ্বে প্রতি ৫ হাজার নবজাতকের মধ্যে একজন মাইটোকন্ড্রিয়া-সংক্রান্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে জন্ম গ্রহণ করে। এই রোগগুলো মূলত শিশুর মস্তিষ্ক, হৃৎপিণ্ড ও পেশির মতো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত করে। এসব রোগে শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ থেমে যায়, হুইলচেয়ারে জীবন কাটাতে হয় অথবা অল্প বয়সেই মৃত্যু ঘটে। মাইটোকন্ড্রিয়াল রোগের এক ভয়ংকর দিক হলো—এগুলো নিরাময়যোগ্য নয়, এবং একবার জিনে প্রবেশ করে পরবর্তী প্রজন্মেও তা সঞ্চারিত হয়।
মানবজীবন সুস্থ ও নিরাপদ করার লক্ষ্যে চিকিৎসাবিজ্ঞান যুগে যুগে নুতন নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছে। এমনই একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার হলো মাইটোকন্ড্রিয়াল ডোনেশন ট্রিটমেন্ট (এমডিটি)—যার মাধ্যমে যুক্তরাজ্যে ইতিমধ্যেই আটজন সুস্থ শিশু জন্ম নিয়েছে, যাদের শরীরে ভয়ংকর মাইটোকন্ড্রিয়াল রোগের সম্ভাবনা ছিল।
🧠 মাইটোকন্ড্রিয়া—শরীরের ক্ষুদ্র শক্তিঘর
মানবদেহের প্রতিটি কোষেই থাকে ছোট্ট একটি অংশ, যার নাম মাইটোকন্ড্রিয়া। এটি এমন এক উপাদান, যা কোষের কাজ চালাতে প্রয়োজনীয় শক্তি জোগায়। একে অনেকটা ছোট ব্যাটারির মতো ভাবা যায়। মাইটোকন্ড্রিয়ার নিজস্ব কিছু জিন থাকে—যেগুলোর ত্রুটিকে বলা হয় মিউটেশন। এই মিউটেশন থাকলে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিকল হতে পারে। সবচেয়ে ভয়ের বিষয় হলো, এই ত্রুটিগুলো মূলত উত্তরাধিকারসূত্রে আসে। একজন মা যদি মিউটেটেড মাইটোকন্ড্রিয়ার বাহক হন, তাহলে তার প্রতিটি সন্তানই সেই ত্রুটি নিয়ে জন্মাতে পারে। এতে শিশুদের বিকাশ থেমে যায়, চলাফেরায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়, এমনকি অনেক শিশু অল্প বয়সেই মারা যায়।
🔬 এমডিটি—এক যুগান্তকারী পদ্ধতি
এই ভয়াবহ উত্তরাধিকার বন্ধ করতে গবেষকেরা উদ্ভাবন করেছেন মাইটোকন্ড্রিয়াল ডোনেশন ট্রিটমেন্ট (এমডিটি) নামে একটি নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে মা, বাবা এবং একজন সুস্থ ডোনার নারীর সমন্বয়ে একটি ভ্রূণ তৈরি করা হয়। এতে মা-বাবার জেনেটিক উপাদান সংরক্ষিত থাকে, কিন্তু ডোনারের সুস্থ মাইটোকন্ড্রিয়া দিয়ে ভ্রূণটিকে সাজানো হয়।
🧪 কীভাবে কাজ করে এমডিটি?
প্রথমে মা ও বাবার ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর মাধ্যমে একটি নিষিক্ত ভ্রূণ তৈরি করা হয়। এরপর মা-বাবার জিনগত অংশটি একটি সুস্থ ডোনারের ডিম্বাণুতে প্রতিস্থাপন করা হয়—যার মাইটোকন্ড্রিয়া একেবারে সঠিক। ফলে এমন একটি নতুন ভ্রূণ গঠিত হয়, যার ৯৯.৮% ডিএনএ মা-বাবার, আর মাত্র ০.২% ডিএনএ ডোনার নারীর মাইটোকন্ড্রিয়া থেকে। এই ভ্রূণ গর্ভে স্থাপন করলে শুরু হয় নতুন এক জীবনের যাত্রা।
👶 এই পদ্ধতির সফলতা
যুক্তরাজ্যে ২০১৫ সালে এই পদ্ধতির অনুমোদন দেওয়ার পর সারা বিশ্বের গবেষকরা অপেক্ষায় ছিলেন—এই নতুন প্রযুক্তি কতটা কার্যকর হবে? ২০১৭ সালে নিউক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ক্লিনিককে প্রথম লাইসেন্স দেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় এমডিটি পদ্ধতিতে জন্ম নেওয়া আটটি শিশুই সুস্থ এবং মাইটোকন্ড্রিয়াল রোগের কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি।
যদিও কেউ কেউ সামান্য সমস্যা (যেমন পেশির টান বা ইউরিন ইনফেকশন) নিয়ে জন্মেছিল, সেগুলো চিকিৎসার মাধ্যমে সহজেই সমাধান করা গেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, এই শিশুদের মধ্যে মিউটেটেড মাইটোকন্ড্রিয়া নেই বা খুব কম মাত্রায় আছে, যা বিপজ্জনক নয়।
🌍 সামাজিক গুরুত্ব
এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুসারে, এই পদ্ধতি নিরাপদ এবং কার্যকর। তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, আরও বিস্তৃত গবেষণা প্রয়োজন, বিশেষ করে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব জানতে। কিন্তু এটা বলা যায়, এক সময়ের অসম্ভব ধারণাই আজ বাস্তব হয়েছে।
এই পদ্ধতির মাধ্যমে অসংখ্য পরিবার তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ভয়ংকর ঝুঁকি থেকে রক্ষা করতে পারবে। রোগ প্রতিরোধে এমডিটি শুধু চিকিৎসা নয়, এটি এক ধরনের জীবনের উপহার।
🧬 নৈতিক ও বৈজ্ঞানিক ভাবনা
এমডিটি পদ্ধতিতে তিনজন মানুষের ডিএনএ যুক্ত থাকায় প্রশ্ন উঠেছে—
নবজাতকের কি তিন অভিভাবক?
তার জিনগত পরিচয় কি?
উত্তরাধিকারই বা কি হবে?
যেহেতু দাতা নারীর অংশ নবজাতকের মাত্র ০.1% জিন বহন করে—শুধুমাত্র মাইটোকন্ড্রিয়ার জন্য। কাজেই শিশুর মূল পরিচয় রয়ে যায় তার বাবা-মায়ের মধ্যেই।
🌟 মাইটোকন্ড্রিয়ার ক্ষুদ্র ত্রুটি একেকটি জীবনের জন্য হয়ে উঠে মৃত্যুর কারণ। আজ বিজ্ঞানের কল্যাণে সেই অনিবার্য ভবিষ্যৎকে পাল্টে ফেলা সম্ভব হচ্ছে। এ যেন এক কঠিন উত্তরাধিকারকে থামিয়ে দিয়ে নতুন জীবনের সুযোগ তৈরি করা—যেখানে হার মানা নয়, জয়ই শেষ কথা।
---
#health #Genetics #Cell #embryo #disease #trend #MRKR #viralpost #mitochondria #nucleus #BMW