বিলেতের রাজ-পরিবারের ইতিহাসে অন্যতম প্রভাবশালী এবং সুদীর্ঘ ৬৩ বছর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন রানি ভিক্টোরিয়া। ভিক্টোরিয়ার সুবর্ণ জয়ন্তীর উপহার হিসেবে ভারত থেকে পরিচারক হিসেবে দুই জনকে বিলেতের রাজপ্রাসাদে পাঠানো হয়েছিল। তাদের একজন ছিলেন আগ্রা থেকে পাঠানো ২৪ বছর বয়সী আব্দুল করিম। ১৮৮৭ সালে উইন্ডসর ক্যাসেলে পরিচারক হিসেবে যোগ দেয়ার পর মাত্র এক বছরের মাথায় প্রাসাদের এক ক্ষমতাশীল ব্যক্তিত্বে পরিণত হন করিম।
কাজ পছন্দ না হওয়ায় চাকরি ছাড়ার কথা ভেবেছিলেন করিম। কিন্তু রানির অনুরোধে শেষ পর্যন্ত তিনি থেকে যান। সাধারণ পরিচারক থেকে ব্রির্টিশ রানি ভিক্টোরিয়াকে উর্দু শেখানোর দায়িত্বে নিয়োজিত হন লম্বা ও সুদর্শন তরুণ আবদুল করিম। রানি তাকে মুনশী বা শিক্ষক হিসেবে পদায়ন করেন। রানির শিক্ষক বা মুন্সি হয়ে উর্দু শেখানোর পাশাপাশি ভারত সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় তাকে শেখাতে শুরু করেন করিম। আস্তে আস্তে করিম রানির ঘনিষ্ঠতম এক মানুষ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
১৮৬১ সালে স্বামী প্রিন্স আলবার্টের মৃত্যুর পর স্কটিশ ভৃত্য জন ব্রাউনের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয় রানির। তবে শেষ জীবনে ১৪ বছর আব্দুল করিম জন ব্রাউনের চেয়েও রানির কাছের মানুষ ছিলেন। জন ব্রাউন তার আস্থাভাজন ছিলেন বটে, তবে করিমকে তিনি পরিচারকের চেয়ে অনেক উঁচু মর্যাদায় রেখেছিলেন।
করিমের যুক্তরাজ্যে আসার পর থেকে শুরু করে ১৯০১ সালে রানির মৃত্যুর মধ্যবর্তী কয়েক বছরে করিমকে লেখা চিঠিতে 'তোমার স্নেহময়ী মা' কিংবা 'তোমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু' লিখে স্বাক্ষর করতেন রানি। কিছুক্ষেত্রে লেখা শেষে তিনি চিঠিতে চুমু দিতেন, যা সেই সময়ে অত্যন্ত অস্বাভাবিক একটি বিষয় ছিল।
করিম ও রানির মধ্যে নিঃসন্দেহে আবেগপূর্ণ একটি সম্পর্ক ছিল। ধারণা করা হয় মা-ছেলের সম্পর্ক ছাড়াও তাদের সম্পর্কের বহু স্তর ছিল যা এক ভারতীয় তরুণকে ৬০ বছরের বেশি বয়সী এক নারীর আপন করে তুলেছিল।তাদের সম্পর্ক প্লাটোনিক ভালবাসার উদাহরণ বলা যেতে পারে। করিমের স্ত্রীকে রানি বিলেতে থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন। তাঁকে আগ্রায় জমি বরাদ্দ দিয়েছিলেন। ভিক্টোরিয়া করিমের পরিবারকেও নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করতেন।
রানি ভিক্টোরিয়ার সাথে একান্তে গল্প করতেন আবদুল করিম। তাঁরা একসাথে ভ্রমন করতেন। হাইল্যান্ড কটেজে নিরিবিলি রাত কাটাতেন। তাঁরা দুজন রাতভর প্রচুর গল্প করে কাটালেও তাদের মধ্যে প্রণয়ের সম্পর্ক ছিল না বলেই ধারণা করা হয়। চিত্রকর দিয়ে করিমের কয়েকটি প্রতিকৃতি আঁকিয়েছিলেন রানি। স্বামী প্রিন্স অ্যালবার্ট যখন মারা যান তখন ভিক্টোরিয়া বলেছিলেন-আমি আমার স্বামী, সবচেয়ে ঘনিষ্ট বন্ধু, বাবা ও মাকে হারালাম। করিমও তাঁর জীবনে হয়তো একই ধরনের ভূমিকা পালন করেছিল।
রানির ওপর করিমের প্রভাব এতোটাই বেশি ছিল যে তিনি করিমকে উইন্ডসর ক্যাসেলে নিজের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার প্রধান শোকপালনকারীদের একজন হিসেবে নির্ধারণ করেন। যদিও রানি জানতেন যে পরিবারের কাছ থেকে এরজন্য তীব্র বিরোধিতার সম্মুখীন হবেন।
রানি ও করিমের সম্পর্ক নিয়ে রাজপরিবারের সদস্য ও কর্মচারীদের মধ্যে নানা রকম গুঞ্জন সৃষ্টি হয়েছিল। অন্য পরিচারকরা তাঁকে হিংসা করতো। করিম রাজপরিবারে এতটাই অস্বস্তি সৃষ্টি করেছিলেন যে রানির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে তার পুত্র সপ্তম এডওয়ার্ড কোন রকম কারণ দর্শানো ছাড়াই করিমকে বরখাস্ত করেন এবং ভারতে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেন। একইসঙ্গে রানি ও করিমের সম্পর্কের যাবতীয় প্রমাণাদি করিমের বিলেত ও ভারত বাড়ি গিয়ে যেন ধ্বংস করে ফেলা হয়, সেই নির্দেশও দেন তিনি। রানির মেয়ে রাজকন্যা বিয়েত্রিচ সকল প্রাসাদে চিঠি এবং অন্যান্য দলিল খুঁজে খুঁজে বের করে সেগুলো মুছে ফেলেন।
রাজ পরিবার রানি ও করিমের সম্পর্কের সকল নিদর্শন নিখুঁতভাবে মুছে ফেলার চেষ্টা করলেও ভিক্টোরিয়ার মৃত্যুর একশো বছর পর একজন সাংবাদিকের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে সেই সম্পর্ক উন্মোচিত হয়। তাঁদের এই ঐতিহাসিক সম্পর্ক নিয়ে গ্রন্থ রচিত হয়েছে, ২০১৮ সালে 'Victoria and Abdul' নামে একটি সিনেমা নির্মাণ করা হয়।
#victorian #trend #photography #royalfamily
(https://www.vanityfair.com/hollywood/2017/09/queen-victoria-and-abdul-real-story?)
No comments:
Post a Comment