প্রবাস জীবন শেষে দেশে ফিরে নিজের পেশা শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এরমধ্যেই জাকার্তা অবস্থান কালে বন্ধুতে পরিণত হওয়া এক চীনা চিকিৎসক WeChat এর মাধ্যমে তার মাতৃভূমিতে শুরু হওয়া একটি ভাইরাসজনিত নুতন শ্বাসকষ্ট রোগের সংবাদ জানালো। সে তখন তার জন্মস্থান চীনের হুবেই প্রদেশে ফিরে গিয়েছে। বিশ্ব সংবাদ মাধ্যমে তখনও বিষয়টি শিরোনাম হয়নি।
ঢাকায় ফিরে আমার নিজের পেশাগত জীবনে ব্যস্ততা শুরু হয়নি বিধায় রোগটি সমন্ধে কৌতূহলী হয়ে জানার চেষ্টা করতে থাকলাম। চীনা বন্ধুর কাছ থেকে রোগটির ভয়াবহতা জেনে অজান্তেই শিউরে উঠেছিলাম। সে জানিয়েছিল হয়তো রোগটি মানুষের মাধ্যমে ছড়ায় না। ততোদিনে বিষয়টি বিশ্ব সংবাদ মাধ্যমে গুরুত্ব পেতে শুরু করেছিল। জানুয়ারি মাসের ১৫ তারিখে চীন সরকার ঘোষণা দিল রোগটি হয়তো মানুষের মাধ্যমে সংক্রমনের ঝুঁকি রয়েছে, যদিও WHO তখনও বলছিল মানুষের মাধ্যমে ছড়ায় না।
ইন্টারনেট ঘেটে যতোদুর সম্ভব নুতন এই রোগটি সমন্ধে জানার চেষ্টা করছিলাম আমি। যেহেতু চীনের একাধিক নগরীর সংগে আমাদের বিমান যোগাযোগ রয়েছে তাই মানুষের মাধ্যমে সংক্রমণের খবরে কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম। উল্লেখ্য আমি একজন ত্বকের চিকিৎসক হলেও জনস্বাস্থ্য বিষয়ে মাষ্টার্স করেছি এবং বিশ্বের জনস্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ করতে উৎসাহ বোধকরি। যাই হোক জানুয়ারির ১৫ তারিখেই দেশের আন্তর্জাতিক বন্দরগুলোতে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহন করার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে সামাজিক মাধ্যমে করোনা নিয়ে পোষ্ট দেয়া শুরু করলাম। তারপর বিভিন্ন সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ কি ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করছে সেগুলোর সচিত্র পোষ্ট করার চেষ্টা করেছি আমি। বলাবাহুল্য আমাদের বন্দরগুলো তখনও গা ছাড়া ঢিলেঢালা ভাবেই চলছিল। একপর্যায়ে জনমতের চাপে চীনের হুবেই প্রদেশ থেকে প্রত্যাগত বাংলাদেশী দের বাধ্যতামূলক কোয়ারিন্টিনে নেয়া হলো। তারপর বেশ সন্তূষ্ট চিত্তে মহামারী নিয়ন্ত্রণে আমরা বিদেশ প্রত্যাগতদের কোয়ারিন্টিনে রাখার প্রয়োজনীয়তার কথা ভুলেই বসলাম।
ইতিমধ্যেই এশিয়া পাড়ি দিয়ে ইউরোপের ইতালি হয়ে উঠেছে মৃত্যুপুরী। সেখানকার সংবাদ মাধ্যমেও নজর রাখছিলাম, গুগল মামার সাহায্য নিয়ে অনুবাদ করে সেগুলো পড়তাম। একদিন সন্ধ্যায় দেখলাম ইতালি প্রবাসী বাংলাদেশী ভর্তি উড়োজাহাজ ছাড়ছে, যা শিরোনাম হয়েছে সেদেশের সংবাদ মাধ্যমে। ইতালি থেকে প্রত্যাবর্তনকারীদের বিমানবন্দর থেকে সরাসরি প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারিন্টিনে নেয়ার গুরুত্ব দিয়ে পোষ্ট করেছিলাম। সামাজিক মাধ্যমের কল্যাণে দেশের মানুষ এবং সংবাদ মাধ্যম তখন সচেতন এবং সোচ্চার হয়ে উঠেছে। ইতালি থেকে প্রবাসী বহনকারী সেই প্রথম উড়োজাহাজটি পরদিন সকালে বিমানবন্দরে অবতরণের পর যাত্রীদের কোয়ারিন্টিনে নেয়া হলো বটে কিন্তু তাদেরকে রাখার স্থানটিতে কোন ধরনের প্রস্তুতি ছাড়াই। তাদের প্রতিবাদ বিক্ষোভের মুখে সরকার বাড়িতে কোয়ারিন্টিনে থাকার শর্তে মুক্তি দিতে বাধ্য হলো। আমরা কোভিড ১৯ মহামারী নিয়ন্ত্রণে রাখার সবচেয়ে বড়ো সুযোগটি হেলায় ফেলায় হাতছাড়া করলাম চুড়ান্ত অব্যবস্থাপনার কারণে। তারপর আরো অনেক উড়োজাহাজ অবতরণ করেছে, যাত্রীরা সবাই বাড়িতে কোয়ারিন্টিনের শর্তে ছাড়া পেয়ে ঘুরে ফিরে বেড়িয়েছে, নিমন্ত্রণ খেয়েছে, রোগ ছড়িয়েছে নিজের অজান্তেই।
মার্চের ৮ তারিখে সরকারি ভাবে বাংলাদেশে কোভিড ১৯ রোগী সনাক্তের ঘোষণা দেয়া হলো। পরিস্থিতি মোকাবেলায় একপর্যায়ে দুরপাল্লার যানবাহন বন্ধ না করে, জনগণকে নির্দেশনা বা সতর্কবার্তা না দিয়েই লকডাউনের নামে ছুটি ঘোষণা করা হলো। মানুষ ঈদের আমেজে স্রোতের মতো যানবাহনে গাদাগাদি করে বড় শহর ছেড়ে পাড়ি জমালো গ্রামের বাড়িতে। এসব মানুষের মাধ্যমে কোভিড ঢাকা থেকে ছড়িয়ে পড়েছে দেশের আনাচে কানাচে সেটি এখন নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। কফিনে সবশেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছিল পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। অতপর সীমিত পরিসরের নামে কলকারখানা খুলে দেয়া হয়েছে। শপিং মল, দোকানপাট , ধর্মীয় উপাসনালয়ও খুলে দেয়া হয়েছে, যদিও মে মাসের শুরু থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে কোভিড রোগীর সংখ্যা। অবকাঠামো, চিকিৎসা সরন্জামের অপ্রতুলতা এবং সর্বোপরি আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা দৃশ্যমান হয়েছে ইতিমধ্যেই। এই পরিস্থিতি আমরা কিভাবে মোকাবেলা করবো সেটি এখন অনেকটাই প্রকৃতি নির্ভর হয়ে পড়েছে।
দ্রুত উন্নয়নশীল একটি দেশের অর্থনীতির চাকা হঠাৎ থেমে গিয়েছে। সঠিক এবং সমন্বিত ব্যবস্থা নিতে না পারলে মহামারীতে মানুষের মৃত্যুর চেয়েও মারাত্মক অর্থনৈতিক বিপর্যয় অপেক্ষা করছে আমাদের সামনে।
সময়ে এক ফোড়, অসময়ে দশফোড় এই প্রবাদ বাক্যটি মেনে চলে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করলেও কোভিড ১৯ মহামারী আমাদের দেশে প্রবেশ করতো অবশ্যই। জনস্বাস্থ্যের নিয়ম অনুসারে যে রোগের নির্দিষ্ট কোন ঔষধ নেই, সেই রোগের মহামারি মোকাবেলা করতে চিকিৎসা সেবা দেয়ার চেয়ে প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থা গ্রহন করাটা সবচেয়ে ভালো পন্থা। দক্ষিনপুর্ব এশিয়ার দেশ ভিয়েতনামের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায় আমরা কিভাবে সুযোগ হাতছাড়া করে উন্নয়নের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে কতোটা ভূল করে ফেলেছি এবং এখনও করছি। সম্ভবত আমরা হেলায়ফেলায় আত্মহুতি দিয়ে একটি স্বপ্নের মৃত্যু ঘটাতে চলেছি😢!
লেখক:
চিকিৎসক, ত্বক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ
#COVID19 #MRKR
No comments:
Post a Comment