সময়টা উনিশ শতক। ব্রিটিশ শাসন পুরোপুরি কায়েম হয়ে গেলেও কিছু কিছু দেশীয় রাজ্য তখনও স্বমহিমায় বিরাজ করছে। তেমনই এক রাজ্য অযোধ্যা। বসন্ত এসেছে, রঙ লেগেছে নবাবের মনেও। কবে যে আবির মেখে উদযাপন করবেন! কিন্তু হঠাৎ নবাবের কানে এল, হিন্দুরা নাকি এবছর হোলি খেলবে না। কিন্তু কেন? রাজদরবারে ডাক পড়ল কয়েকজন ব্রাহ্মণের। তাঁরা নবাবকে জানালেন, যেহেতু একই দিনে মহরম এবং হোলির দিন পড়েছে, তাই সেবছরের জন্য রং মাখার অনুষ্ঠান বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
ইসলাম ধর্মে রংকে হারাম মনে করা হয়। শরীরের কোথাও রঙ লেগে থাকলে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা মসজিদে প্রবেশ করেন না। কিন্তু হোলির দিনে তো গোটা শহর রঙে ভরে উঠবেই। অওধে হিন্দুদের এই কথা শুনে মৌলভিদেরও ডেকে পাঠালেন নবাব। আর জানিয়ে দিলেন, দুই ধর্মের অনুষ্ঠানই একইরকম মর্যাদার সঙ্গে পালন করা হবে। নিজে মুসলমান পরিবারে জন্মালেও প্রজাদের ধর্মই যে নবাব ওয়াজেদ আলি শাহের ধর্ম। সেখানে হিন্দু মুসলমান ভেদ নেই। সেবারের হোলির অনুষ্ঠানে যথারীতি রং মেখে হাজির হয়েছিলেন নবাব নিজেও।
ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ইতিহাসে নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ এক কিংবদন্তি। ১৮৫৫ সালে প্রবল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মধ্যেও তিনি অযোধ্যার হনুমান গঢ়ী মন্দির রক্ষা করেছিলেন। তবে ব্রিটিশ সরকারকে চিনেছিলেন শত্রু বলেই। চরম এক প্রতিকূল পরিবেশে অনেক বাধা বিপত্তি এড়িয়ে রাজ্য চালাতে হয়েছে তাঁকে।
সময়টা ১৮৫৬ সাল। কোম্পানির কাছে অযোধ্যার নবাবী হারালেন ওয়াজেদ আলী শাহ। পেনশন নিয়ে লখনউয়ের কোনও প্রাসাদে নিশ্চিন্তে থাকতেই পারতেন। তবে লখনৌ থেকে বেনারস হয়ে তাঁর বজরা নিয়ে পৌঁছলেন কলকাতার বিচালিঘাটে। তার ইচ্ছে ছিল কোম্পানির কাছে সওয়াল করবেন সিংহাসন উদ্ধারের জন্য। সফল না হলে যাবেন লন্ডনে, রানি ভিক্টোরিয়ার কাছে। ইংরেজের ন্যায়পরায়ণতা নিয়ে তাঁর মোহ তখনও কাটেনি।
বছর না ঘুরতেই ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহে যোগ দিল অযোধ্যা। কলকাতায় গ্রেফতার করে ওয়াজিদ আলী শাহকে রাখা হলো ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে। মহাবিদ্রোহের পরাজয় দিয়েই লক্ষ্ণৌ শহরে নবাবি শাসনের ইতি ঘটল। দুই বছর বন্দি জীবন শেষে তিনি কলকাতাতেই পেনশন নিয়ে বাকি জীবন কাটিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন।
মেটিয়াবুরুজ অঞ্চলে গড়ে উঠল নির্বাসিত নবাবের নতুন নবাবিয়ানা। যতই নির্বাসন হোক, নবাবিয়ানায় সহজে ছেদ পড়া মুশকিল। নবাব ওয়াজেদ আলি তাই সঙ্গে করে আনলেন ফেলে আসা স্মৃতি। জাঁকজমক বজায় রাখতে কলকাতা শহরের মধ্যেই গড়ে তুলেছিলেন তাঁর পরিচিত দ্বিতীয় এক টুকরো লক্ষ্মৌ। নবাবি সংস্কৃতি, আমোদ আহ্লাদ, এমনকি নবাবি খাবারও তাঁর হাত ধরে কলকাতায় পাড়ি দিল। একদিকে চিড়িয়াখানা, বাইজি সংস্কৃতি আর অন্যদিকে বিরিয়ানি কিংবা পাখির লড়াই অথবা ঘুড়ি ওড়ানো কলকাতার অন্দরমহলে দিব্যি জায়গা করে নিল তাঁর আমলে।
তবে জৌলুশ জাঁকজমকপূর্ণ নবাবি সংস্কৃতির সঙ্গে সঙ্গে ওয়াজিদ আলী শাহ ছিলেন সাহিত্য, সঙ্গীত, নৃত্যশিল্পের অনুরাগী ও পৃষ্ঠপোষক। মেটিয়াবুরুজে নবাবের বাসগৃহ রীতিমতো শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পীদের আড্ডায় পরিণত হয়েছিল। লখনউয়ে ওয়াজিদ আলির দরবারেই ঠুমরি জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছায়। আর মেটিয়াবুরুজ থেকে তা ছড়িয়ে পড়ে কলকাতার বুকে।
অনেক গান রচনা করেছেন তিনি। মাতৃভূমি লখনউ থেকে তাঁর বিচ্ছিন্নতা প্রকাশ করতে গিয়ে 'বাবুল মোরা নাইয়াহার ছুটো হি যায়ে (বাবা, আমার বাড়ি এখন আমার কাছে হারিয়ে গেছে)' রচনা করেছিলেন। এই ঠুমরির মধ্যে আছে তাঁর বিলাপ, 'আংরেজ বাহাদুর আয়ে, মুলক লেঁই লিহোঁ (সাহসী ইংরেজরা এসে দেশ কেড়ে নিয়েছে)।'
তাঁর দরবার যন্ত্রসংগীতেও ছিল তুলনাহীন। সরোদ, সানাই, তবলাকেও কলকাতায় জনপ্রিয় করে তোলেন তিনি। কত্থক নৃত্যশৈলীকে তিনি এতটাই আত্মস্থ করেছিলেন যে অনেক নৃত্যনাটিকাও তৈরি করেছিলেন। তিনি কত্থকের নতুন এক লখনউ ঘরানা তৈরি করে ফেলেছিলেন। কত্থক সর্বভারতীয় নৃত্যকলায় জনপ্রিয় করার কৃতিত্ব তাঁর।
লেখনী ও মঞ্চেও পারদর্শী ছিলেন এই নবাব। ১৮৪৩ সালে লেখা নাটক ‘রাধা কানহাইয়া কা কিস্সা’ মঞ্চস্থ করেন। এই কিস্সাকেই বলা যায় প্রথম আধুনিক উর্দু নাটক। হিন্দুস্তানি থিয়েটারের প্রথম নাট্যকার হিসেবে তাঁকে উল্লেখ করা হয়ে থাকে।
বাংলায় যখন নবজাগরণের ঢেউ চলছে ঠিক তখন লক্ষ্ণৌ ঘরানার সাংস্কৃতিক চর্চা চলছিল নবাবের মেটিয়াবুরুজের দরবারে। ঘুড়ি উৎসব, আলু বিরিয়ানি, চিড়িয়াখানা ইত্যাদি আরো অনেক কিছুই কলকাতার সংস্কৃতির অংশ হিসেবে পরিনত করার কৃতিত্ব নবাব ওয়াজিদ আলী শাহকে দেয়া হয়ে থাকে।
(সংগৃহিত ও সম্পাদিত)