আজকের সিঙ্গাপুরকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে এক সময় এই এলাকাটা ছিল কেবল সমুদ্রঘেরা এক ছোট্ট মাছধরার গ্রাম, নাম ছিল তেমাসেক—অর্থাৎ, সমুদ্রঘেরা শহর। তখনও আকাশচুম্বী অট্টালিকা ছিল না, ছিল না প্রযুক্তির শাসন, ছিল জঙ্গল, কাদা আর কিছু ডিঙি নৌকা। তেমাসেক ছিল মালয় উপদ্বীপের এক কোণায় অবস্থিত একটা ছোট উপকূলীয় ঘাঁটি, যেটা ব্যবসার দিক থেকে ধীরে ধীরে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছিল। চীনের নাবিকেরা এর কথা লিখে গেছেন বহু আগে, বলেছিলেন—এখানে রাজা আছে, সৈন্য আছে, কিন্তু স্থায়িত্ব নেই। কখনও থাই রাজ্যের দখলে, কখনও জাভার মজাপাহিতদের হাতে।
১৩শ শতকের দিকে তেমাসেকে এসে পৌঁছান সুমাত্রার শ্রীবিজয়া রাজবংশের রাজপুত্র সং নিলা উৎমা। বর্ণনামতে, একদিন তিনি জঙ্গলের ধারে এমন এক প্রাণী দেখলেন—দাঁড়ানো, সজাগ, চোখে হিংস্র দীপ্তি—যা তিনি সিংহ ভেবে নিলেন। সেই বিভ্রম থেকেই এল নাম—সিংহপুর, অর্থাৎ সিংহের শহর। যদিও বাস্তবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কখনও সিংহ ছিল না, তবু এই নামটাই রয়ে গেল কালের পর কালে, পরে সংক্ষিপ্ত হয়ে দাঁড়াল—সিঙ্গাপুর।
পরবর্তী কয়েকশো বছর সিঙ্গাপুর কেবল এক দ্বীপ হয়ে রয়ে যায়, যার কৌশলগত প্রতিবেশী রাজ্যগুলোর নজরে ছিল সবসময়ই। মজাপাহিত, সুকোথাই, মালাক্কা সালতানাত—সবাই এক সময় না এক সময় এই জায়গার উপর আধিপত্য কায়েম করেছিল। এই দ্বীপে ১৫শ শতকে ইসলাম ও মালয় সংস্কৃতির ছোঁয়া এসে লাগে। কিন্তু ১৬শ শতকে পর্তুগিজরা মালাক্কা দখল করলে পুরো অঞ্চলটা পড়ে যায় অগোচরে। জনশূন্য, নিঃসঙ্গ এক দ্বীপে পরিণত হয় সিঙ্গাপুর, গুরুত্বও তখন কমে যায়।
এই নিস্তরঙ্গ পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে ১৮১৯ সালে। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিনিধি স্যার স্ট্যামফোর্ড র্যাফেলস সিঙ্গাপুরে পা রাখেন, এবং বুঝে ফেলেন—এটাই হতে পারে মালয় উপদ্বীপের সবচেয়ে কার্যকর সমুদ্রবন্দর। স্থানীয় সুলতানের সঙ্গে চুক্তি করে র্যাফেলস এখানে ব্রিটিশ বাণিজ্য কেন্দ্র গড়ে তোলেন। শুরু হয় ঔপনিবেশিক অধ্যায়, দ্রুতই সিঙ্গাপুর হয়ে ওঠে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত ঘাঁটি। বানিজ্যিক ও সুমদ্রবন্দরের ব্যস্ততায় চীনা, মালয়, ও ভারতীয় অভিবাসনের ঢলে পাল্টে যেতে থাকে দ্রুত গতিতে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান দখল করে নেয়। সেই যুদ্ধে ব্রিটিশদের আত্মসমর্পণ ছিল ঐতিহাসিক লজ্জার মুহূর্ত। যুদ্ধ শেষে আবার ব্রিটিশরা ফিরে আসে, শাসনের বৈধতা মানুষের মনে ফুরিয়ে যায়। ১৯৬৩ সালে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভে করার পর মালয়েশিয়ার অংশ হিসেবে কিছুদিন ছিল। ১৯৬৫ সালে মালয়েশিয়া থেকে আলাদা হয়ে সার্বভৌম দেশ হয়।
স্বাধীনতার শুরুর দিনগুলো সহজ ছিল না—ছিল না কোন খনিজ সম্পদ, নেই খাদ্য-নির্ভরতা, নেই পানীয় জলের নিজস্ব উৎস। চারদিকে শুধু অনিশ্চয়তা আর চ্যালেঞ্জ। কিন্তু তখনকার প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান ইউর নেতৃত্বে দেশটি এক অনন্য পরিকল্পনামাফিক উত্থানের পথে হাঁটে। রাষ্ট্র-পরিচালনার কঠোরতা, প্রশাসনিক দক্ষতা, শিক্ষা আর প্রযুক্তিকে অগ্রাধিকার দেওয়ার ফলে সিঙ্গাপুর হয়ে ওঠে এক অলৌকিক রাষ্ট্র—যেখানে শৃঙ্খলা মানে উন্নতি, আর পরিচ্ছন্নতা মানে সম্মান।
আজকের সিঙ্গাপুর বিশ্ব বাণিজ্যের এক বিশাল কেন্দ্র, যেখানে মালয়, চীনা, ভারতীয় ও পাশ্চাত্যের সংমিশ্রণে তৈরি হয়েছে এক বহুসাংস্কৃতিক সমাজ। এককালে যাকে সিংহপুর নামে কল্পনার রাজ্যে ঠাঁই দেওয়া হয়েছিল, সেই শহর আজ বাস্তবেই দাঁড়িয়ে আছে আধুনিক সভ্যতার এক মডেল হিসেবে। রাজপুত্রের কল্পিত সিংহ একদিন হয়তো ছিল না, কিন্তু আজকের সিঙ্গাপুর নিজেই এক বাঘা শক্তি—একদম বাস্তব, একদম অদম্য।
---
#SingaporeHistory #ColonialToModern #MRKR #SoutheastAsiaTales #সিংহপুর\_থেকে\_সিঙ্গাপুর #singapore #trend #viralpost #photo #history
No comments:
Post a Comment