মহাশোল নামটি শুনে শোল মাছের বড় আকারের একটি মাছ বলে ভ্রম হতেই পারে। আসলে মহাশোল (Mahseer) পাহাড়ি স্বাদুপানির ততোধিক সুস্বাদু একটি মাছ। শক্তিশালী গড়নের এই মাছকে বলা হয় “নদীর বাঘ” বা “রাজা মাছ”, যা একসময় হিমালয়ের পাদদেশে দক্ষিণ এশিয়ার নদীনির্ভর প্রাকৃতিক পরিবেশের অংশ ছিল। তবে পরিবেশগত পরিবর্তন, অতিরিক্ত শিকার এবং আবাসস্থল ধ্বংসের কারণে এই মাছ এখন সংকটাপন্ন।
এই মাছের প্রধান বিস্তার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়—বিশেষ করে হিমালয় ঘেষা অঞ্চলগুলিতে। ভারতের হিমালয় পার্বত্য অঞ্চল, উত্তরাখণ্ড, হিমাচল প্রদেশ, আসাম, নাগাল্যান্ড, মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক ও কেরাল, নেপালের গণ্ডক, কার্নালি ও কালী নদী, ভুটানের পাহাড়ি স্বচ্ছ নদী,পাকিস্তানে সিন্ধু নদীর পাহাড়ি উপনদী, শ্রীলঙ্কা ও বার্মার কিছু পাহাড়ি জলে এদের বিচরণভূমি।
বাংলাদেশে মহাশোল মাছের প্রধান বিচরণক্ষেত্র হলো উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের পাহাড়ি নদী ও ঝরনা। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো সোমেশ্বরী নদী, যা নেত্রকোণার দুর্গাপুর এলাকায় মেঘালয়ের পাহাড় থেকে নেমে এসেছে। স্বচ্ছ জল, পাথুরে তলদেশ আর ঝরনাধারা মহাশোলের জন্য এক আদর্শ বিচরণ ক্ষেত্র। এছাড়াও এর আবাসস্থল ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের সাঙ্গু, মাতামুহুরি, সিলেটের সীমান্তবর্তী পাহাড়ি নদী যেমন লোভা, সারি ইত্যাদি।
কার্প জাতীয় এই মাছের দেহ শক্ত ও লম্বাটে, মাথার আকার তুলনামূলক বড় এবং ঠোঁট মোটা, নিচের দিকে মুখ। আঁশ বড় ও চকচকে, সোনালি-বাদামি রঙের ঝিলিক। স্বভাবে শান্ত হলেও দ্রুতগামী স্রোতে এরা দক্ষ সাঁতারু। সাধারণত পাথরের শেওলা, পোকামাকড়, ছোট মাছ—এসবই এদের খাদ্য তালিকায় পড়ে। হিমালয় অঞ্চলের মহাশোল ওজনে ৩ কেজি থেকে ১২ কেজি হতে পারে।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, মহাশোল এখন বাংলাদেশে প্রায় বিলুপ্ত। নদীর স্বাভাবিক স্রোতের ব্যাঘাত (ড্যাম ও বাঁধ নির্মাণ), অতিরিক্ত বালু উত্তোলনে নদীর তলদেশ পরিবর্তন,
অপরিকল্পিত মাছ শিকার, বিষ ও ডিনামাইটের ব্যবহার, প্রজনন মৌসুমে সুরক্ষা না থাকা এবং স্থানীয় মানুষজনের অজ্ঞতা ও সরকারি নজরদারির ঘাটতিতে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
প্রাকৃতিক মহাশোল দুর্লভ হলেও বর্তমানে কৃত্রিমভাবে চাষ করা মহাশোল বাজারে পাওয়া যায়। দুর্লভতা, স্বাদ, এবং প্রাকৃতিক উৎস থেকে সংগ্রহের জটিলতার কারণে মহাশোল একটি দামী মাছ। চাষ করা মহাশোল প্রতি কেজি ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা বিক্রি হয়ে থাকে।