Saturday, May 17, 2025

ফলের রাজা আম

বিশ্বব্যাপী আম একটি জনপ্রিয় রসালো, সুগন্ধি ও পুষ্টিগুণে ভরপুর ফল। আম কৃষিখাতে অর্থনৈতিকভাবেও গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বজুড়ে আমপ্রেমীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলে কোন জাত সবচেয়ে মিষ্টি বা টেকসই, আর কোন দেশের আম রপ্তানির বাজার দখল করেছে বেশি।

আমের (Mango) বৈজ্ঞানিক নাম Mangifera indica, যা Anacardiaceae পরিবারের অন্তর্গত। ভারত উপমহাদেশ, বিশেষত উত্তর-পূর্ব ভারতের আসাম ও বার্মা অঞ্চলে, প্রায় ৪ হাজার বছরেরও বেশি সময় আগে আমের ইতিহাস পাওয়া যায়। সেখান থেকেই এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা এবং পরবর্তীকালে দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে।

চীনের ঐতিহাসিক রচনাতেও খ্রিস্টপূর্ব ২০০ অব্দে আমের উল্লেখ পাওয়া যায়। মুঘল সম্রাট আকবর তাঁর দরবারে ১ লাখ আমগাছের বাগান স্থাপন করেছিলেন—যা আজকের ভারতের মালিহাবাদ অঞ্চলের 'আমের রাজধানী' নামে পরিচিত। বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৬১ মিলিয়ন টন আম উৎপাদিত হয়, যার প্রায় তিন-চতুর্থাংশই এশিয়ায় উৎপাদিত হয়। বিশ্বে আমের মোট বাজারমূল্য কমবেশি ৫৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

আম উৎপাদনে ভারত শীর্ষস্থান দখল করে আছে। দেশটি বছরে প্রায় ২৬.৩ মিলিয়ন টন আম উৎপাদন করে থাকে, যা বৈশ্বিক উৎপাদনের প্রায় ৪০%। আলফানসো, কেসার, রসপুরি, বানগানাপল্লি ও পশ্চিমবঙ্গের হিমসাগর ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় আমের জাত। এসব আমের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মিষ্টতা, ঘন রস, মনোমুগ্ধকর সুগন্ধি ও আঁশহীন টেক্সচার।


দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশ ইন্দোনেশিয়া। এই দেশটি বছরে প্রায় ৪.১ মিলিয়ন টন আম উৎপাদন করে। ‘গেডং গিনচু’ ও ‘আরুমানিস’ জাতের আম দেশটির গর্ব। সুগন্ধি, রসালো ও তুলনামূলকভাবে ছোট আকৃতির এই জাতের আম দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাজারে ব্যাপকভাবে চাহিদাসম্পন্ন। 

আম উৎপাদনে চীনও পিছিয়ে নেই। প্রায় ৩.৮ মিলিয়ন টন উৎপাদন করে দেশটি তৃতীয় স্থানে রয়েছে। চীনের আমের জাত যেমন ‘তাইনং’ ও ‘সাননিয়ান’ বআধুনিক কৃষিব্যবস্থায় উৎপাদিত, টেকসই ও সহজে সংরক্ষণযোগ্য।

চতুর্থ স্থানে থাকা পাকিস্তান তাদের ‘চৌসা’, ‘সিন্ধরি’ ও ‘ল্যাংড়া’ জাতের জন্য বিখ্যাত। অতিমিষ্ট, নরম টেক্সচারের এই আম মধ্যপ্রাচ্যের রপ্তানি বাজারে ব্যাপক জনপ্রিয়।



আমেরিকা মহাদেশে মেক্সিকো ও ব্রাজিল যথাক্রমে পঞ্চম ও ষষ্ঠ স্থানে অবস্থান করছে। মেক্সিকোর আতাউলফো ও টমি অ্যাটকিন্স জাতের আম ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। তুলনামূলকভাবে লম্বাটে, কম আঁশযুক্ত ও সংরক্ষণে দীর্ঘস্থায়ী আমের জাতগুলো। 


আফ্রিকার দেশ মালাউইও আম উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য এক শক্তি। বছরে প্রায় ১.৯ মিলিয়ন টন আম উৎপাদন করে তারা সপ্তম স্থানে উঠে এসেছে। তারা ‘দোডো’, ‘আলফানসো’ এবং ‘টমি অ্যাটকিন্স’ জাতের আম চাষ করে। 

থাইল্যান্ড, বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম যথাক্রমে অষ্টম, নবম ও দশম স্থানে অবস্থান করছে। বাংলাদেশের আমের কথা না বললেই নয়। দেশের উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিস্তৃতভাবে উৎপাদিত ‘হিমসাগর’, ‘গোপালভোগ’, ‘ল্যাংড়া’, ‘ফজলি’ ও ‘হাঁড়িভাঙ্গা’ জাতের আম শুধু স্বাদে নয়, সুগন্ধি ও ঐতিহ্যে অনন্য। হিমসাগর তুলনামূলক ছোট হলেও স্বাদে অত্যন্ত মিষ্টি ও রসালো। ফজলি আকারে বড়, দেরিতে পাকে এবং রপ্তানির জন্য উপযুক্ত। হাঁড়িভাঙ্গা জাতের আম বিগত কয়েক বছরে বেশ জনপ্রিয় হয়েছে।

বিশ্বের সবচেয়ে দামি আমের নাম নিতে গেলে জাপানের Taiyo no Tamago, অর্থাৎ “সূর্যের ডিম”—সবার আগে উঠে আসে। এটি মূলত মিয়াজাকি প্রদেশে জন্মানো একটি বিশেষ জাতের আম, যা রং, স্বাদ ও উৎকৃষ্ট মানের কারণে বিশ্বে পরিচিতি পেয়েছে বিলাসবহুল ফল হিসেবে।


ভারত উপমহাদেশ ফলের রাজা হিসেবে পরিচিত হলেও, আশ্চর্যের বিষয়, ইউরোপে আম তেমন জনপ্রিয় নয়। এটির পেছনে অবশ্য অনেক কারণ আছে। প্রথমত, আম একটি গ্রীষ্মকালীন মৌসুমি ফল, ইউরোপে উৎপাদিত হয় না। স্বাদ, গন্ধ ও গঠন ঠিক রাখতে হলে আম নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অত্যন্ত সতর্কভাবে পরিবহন করতে হয়। পরিবহন ব্যয়ের কারণে আমের দাম বেড়ে যায় আবার পরিবহনে সময়ের কারণে স্বাদ ও গন্ধ পরিবর্তন ঘটে। সম্ভবত এসব কারণে ইউরোপের দেশগুলোতে আম ততোটা জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারে নাই।

তবে আমের জনপ্রিয়তা ও উৎপাদন বিশ্বজুড়ে বেড়ে চলছে। নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন, সংরক্ষণের আধুনিক পদ্ধতি এবং রপ্তানির সুযোগ বাড়ার ফলে এই ফলটি এখন শুধু ভারতীয় উপমহাদেশে নয়, বিশ্বব্যাপী ফলপ্রেমীদের মন জয় করে চলেছে। আম শুধুমাত্র একটি ফল নয়, বরং এটির সঙ্গে ইতিহাস, সংস্কৃতি, অর্থনীতি জড়িত।  বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন, উন্নত সংরক্ষণ ও পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত হলে আগামী দিনে এই ফলের বাজার আরও বিস্তৃত হবে। দক্ষিণ এশিয়ার মাটিতে জন্ম নেওয়া এই রসালো ফল বিশ্বের সকল দেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠবে অচিরেই।

No comments:

বাংলাদেশে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ: জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক এক হুমকি!

 🧬অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের পর থেকে মানবসভ্যতা যেন এক নতুন জীবন ফিরে পেয়েছে। আগে যেসব সংক্রমণে মানুষ মৃত্যুবরণ করত, সেগুলো অ্যান্টিবায়ো...