ভৌগোলিকভাবে তিনদিক দিয়ে বাংলাদেশ দ্বারা পরিবেষ্টিত এবং আসামের সঙ্গে একটি মাত্র স্থলপথে সংযুক্ত ভারতের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরা।রাজ্যটিতে জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ বর্তমানে বাঙালি। অতীতের সংখ্যাগরিষ্ঠ আদিবাসী সম্প্রদায় এখন জনসংখ্যার মাত্র ৩০ শতাংশ।
ত্রিপুরার মাণিক্য রাজাদের শাসন ছিল এক বর্ণাঢ্য অধ্যায়। রাজারা প্রথমদিকে পূর্ণ স্বাধীন ছিলেন, তবে মোগল শাসক ও বাংলার নবাবদের কাছে একসময় তাদের বশ্যতা স্বীকার করতে হয়। রাজারা বারবার মোগল দরবারে কর দিতেন। পরবর্তীতে, ব্রিটিশ শাসকরাও ত্রিপুরার স্বাধীনতাকে সীমিত করে। পলিটিক্যাল এজেন্টের মাধ্যমে রাজ্য পরিচালনার উপর কড়া নজর রাখত তারা।
দেশভাগের সময় ত্রিপুরায় হিন্দু শরণার্থী এবং পূর্ববঙ্গে ত্রিপুরা থেকে মুসলিম শরনার্থীদের কারণে জনসংখ্যায় বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে। বর্তমানে রাজ্যটির জনসংখ্যার ৮০% হিন্দু এবং মাত্র ৯% মুসলিম ধর্মালম্বী। ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাজনের সময় ত্রিপুরার ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হওয়ার দাবিকে বাস্তবসম্মত করে তুলেছিল। তবে একাধিক রাজনৈতিক, সামাজিক এবং কৌশলগত কারণে তা শেষ পর্যন্ত ঘটেনি।
সে সময় এই ইস্যুতে ত্রিপুরার রাজপরিবার বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। পাকিস্তানে যোগ দেওয়ার পক্ষে ছিলেন ত্রিপুরার রাজপরিবারের সদস্য মহারাজকুমার দুর্জয়কিশোর দেববর্মন এবং রিজেন্সি কাউন্সিলের মন্ত্রী সত্যব্রত মুখার্জী। তাদের সমর্থনে ছিলেন আঞ্জুমান-এ- ইসলামিয়ার নেতা আবদুল বারিক। অন্যদিকে, রাজপরিবারের আরেক অংশ, ত্রিপুরার উপজাতি জনগোষ্ঠী এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা পাকিস্তানভুক্তির বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে ভারতভুক্তির পক্ষে সোচ্চার হয়।
ঠিক এই সময় ১৯৪৭ সালের ১৭ মে মহারাজা বীরবিক্রম কিশোর দেববর্মনের মৃত্যুর পর তার নাবালক পুত্র কিরীট বিক্রম কিশোর দেববর্মন রাজ্যের উত্তরাধিকারী হন। প্রথা অনুযায়ী ব্রিটিশ সরকার রাজ্য পরিচালনার জন্য গঠন করে রিজেন্সি কাউন্সিল বা পরামর্শক পরিষদ। এই কাউন্সিলের নেতৃত্বে ছিলেন মহারানী কাঞ্চনপ্রভা দেবী। হিন্দু ধর্মাবলম্বী রাণী সেই রাজনৈতিক সংকটময় সময়ে ত্রিপুরাকে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করার পথে অগ্রসর হন।
ব্রিটিশরা ভারত-ত্যাগের পরপরই গুজব রটে যায় যে পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম সৈন্যরা ত্রিপুরা আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এবং উপ-প্রধানমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের নির্দেশে ভারত সরকার ত্রিপুরার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করে। আসাম থেকে সেনাবাহিনী প্রেরণ করে এবং জরুরী বার্তা পাঠিয়ে পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে বিষয়টি অবগত করা হয়।
ভিন্ন একটি সূত্র মতে ত্রিপুরার মহারাণীও পূর্ব পাকিস্তানের সাথে যোগদানে আগ্রহী ছিলেন। অবশ্য মহারাণী চাইলেও ত্রিপুরাকে পূর্ব পাকিস্তানের সাথে যুক্ত করতে পারতেন কি না, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। কেননা সেই সময় বিহারে দাঙ্গার প্রতিক্রিয়ায় পূর্ববঙ্গের নোয়াখালী অঞ্চলে দাঙ্গা সৃষ্টি হলে বিপুল সংখ্যক বাঙালি হিন্দু ধর্মাবলম্বী ত্রিপুরা রাজ্যে শরণার্থী হিসেবে প্রবেশ করে। হিন্দু প্রধান রাজ্য ত্রিপুরা এবং মুসলিম প্রধান পূর্ববঙ্গের মধ্যে তখন একটা মনস্তাত্ত্বিক বিরোধ গড়ে উঠে। এই বিরোধ টপকিয়ে বাংলাভাষী এই দুই অঞ্চলকে এক করার মত যোগ্য কোনো নেতৃত্ব তখন ত্রিপুরায় ছিল না।
আরেকটি কারণ তখনকার পূর্ববঙ্গের উর্দুভাষী মুসলিম নেতৃত্ব বা পাকিস্তানের নেতৃত্ব পূর্ববঙ্গকে ভৌগলিকভাবে শক্তিশালী করার প্রতি মনোযোগী ছিলেন না। নেতৃত্বের অদূরদর্শিতা ও অবহেলার কারণেই আরাকান রাজার আবেদন সত্ত্বেও আরাকানকে পাকিস্তানের অংশ করা হয়নি, ত্রিপুরাও চলে যায় ভারতের করায়ত্তে।
১৯৪৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর নাবালক রাজা কিরিটী বিক্রম মাণিক্যের পক্ষে মহারানী কাঞ্চনপ্রভা দেবী দিল্লিতে ত্রিপুরা রাজ্যকে ভারতভুক্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। ১৫ অক্টোবর ত্রিপুরা আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের অংশ হয়। ত্রিপুরার ভারতভুক্তি চুক্তি রাজ্যটির সাড়ে ৫০০ বছরের রাজতান্ত্রিক অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটায়।
(সংগৃহিত ও সম্পাদিত)
#trend #India #Bangladesh #Pakistan #politics