🕯️ব্রিটিশ ভিক্টোরিয়ান আমলে শিল্পবিপ্লব, সাম্রাজ্য বিস্তার এবং সাহিত্য-সংস্কৃতির জন্য ইতিহাস খ্যাত। এই উজ্জ্বলতার আড়ালে ছিল অন্ধকার এক দিক—ওয়ার্কহাউজ বা কর্মগৃহ। প্রথমে যেগুলো পরিকল্পনা করা হয়েছিল দরিদ্রদের কাজ ও আশ্রয় দেওয়ার জন্য, সেগুলো ধীরে ধীরে রূপ নেয় শাস্তিমূলক কারাগারে। এখানে আশ্রয় খুঁজতে আসা মানুষরা মুখোমুখি হতেন অমানবিক পরিবেশ, দীর্ঘ শ্রমঘণ্টা, শিশু শ্রম, অপুষ্টি, রোগব্যাধি আর প্রহরীদের নির্মমতার।
⚖️ দারিদ্র্য থেকে অপরাধে রূপান্তর-
ওয়ার্কহাউজ ব্যবস্থার শেকড় খুঁজে পাওয়া যায় ১৩৮৮ সালের Poor Law Act এ। ব্ল্যাক ডেথের পর শ্রমিক সংকট দেখা দিলে মানুষ উচ্চ মজুরির খোঁজে এক অঞ্চল থেকে অন্যত্র যেতে শুরু করে। রাষ্ট্র তা রুখতে আইন প্রণয়ন করল। ধীরে ধীরে এ ব্যবস্থা দরিদ্রদের ‘সহায়তা’ দেওয়ার পরিবর্তে তাদের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের উপায়ে পরিণত হলো। ষোড়শ শতকে আইন প্রায় স্পষ্ট করে দিল—কেউ যদি কাজ করতে সক্ষম হয়, তবে কাজ না করে কোনো সাহায্য পাবে না। আর যারা কাজ করতে অস্বীকার করবে, তাদের জন্য ছিল house of correction বা সংশোধনাগার।
🏚️ চার্চ থেকে রাষ্ট্রের হাতে-
১৫৩৬ সালে রাজা অষ্টম হেনরি আশ্রম ব্যবস্থা ভেঙে দেওয়ার পর দরিদ্রদের সহায়তার প্রধান উৎসও ভেঙে যায়। তাদের দায়িত্ব নিল রাষ্ট্র ও স্থানীয় পারিশ (parish)। ১৬০১ সালের আইনে প্রতিটি পারিশকে দরিদ্রদের সহায়তার জন্য দায়িত্ব দেয়া হলো। ক্রমে Workhouses Test Act (১৭২৩) ও Gilbert’s Act (১৭৮২) ওয়ার্কহাউজ ব্যবস্থাকে আরও বিস্তৃত করল। উনিশ শতকের শুরুতে প্রায় প্রতিটি এলাকায় একটি করে ওয়ার্কহাউজ দাঁড়িয়ে গেল।
🔨 শোষণের যন্ত্রে পরিণত-
১৮৩৪ সালের New Poor Law কার্যকর করা হয়। আইনে
ওয়ার্কহাউজের চরিত্র আরও নির্মম হলো। পারিশগুলো মিলে গঠিত হলো Poor Law Union এবং অভাবী মানুষদের প্রায় বাধ্যতামূলকভাবে ওয়ার্কহাউজে ঠেলে দেওয়া হলো। ভেতরে তারা পরতেন নির্দিষ্ট ইউনিফর্ম, পরিবারগুলো আলাদা করে রাখা হতো, কথা বলা নিষিদ্ধ ছিল। সেখানে শিশুদের দিয়েও বিপজ্জনক কারখানার কাজ করানো হতো, প্রাপ্তবয়স্করা ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতেন। বিনিময়ে তাদের প্রাপ্য ছিল অল্প খাবার—Oliver Twist-এর কাহিনির মতো, সেখানে দ্বিতীয়বার খাবার চাওয়াও অপরাধ গণ্য হতো।
✍️ সাহিত্য ও প্রতিবাদ-
চার্লস ডিকেন্স তার Oliver Twist উপন্যাসে এক কিশোরের ক্ষুধার্ত জীবনের বর্ণনার মাধ্যমে ওয়ার্কহাউজের অমানবিক বাস্তবতাকে সামনে আনেন। এই সাহিত্যিক প্রতিবাদ সমাজকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। ধীরে ধীরে জনমনে প্রশ্ন উঠল—দারিদ্র্যের সমাধান কি কেবল শাস্তি?
🏥 পরিণতি ও বিলুপ্তি-
উনিশ শতকের শেষদিকে জনসাধারণের বিরোধিতা বাড়তে লাগল। ওয়ার্কহাউজে মৃত্যুহার ছিল প্রবল, বিশেষ করে গুটি বসন্ত ও হামের মতো রোগে। ১৯২৯ সালে নতুন আইনে অনেক ওয়ার্কহাউজ হাসপাতাল হিসেবে রূপান্তরিত হলো এবং ১৯৩০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ওয়ার্কহাউজ ব্যবস্থা বন্ধ ঘোষণা করা হয়। যদিও বহু দরিদ্র মানুষের জন্য অন্য কোনো আশ্রয়ের অভাব থাকায় পুরোপুরি বিলুপ্ত হতে কয়েক বছর সময় লেগে যায়।
📌 ভিক্টোরিয়ান ওয়ার্কহাউজ ইতিহাসে এক কঠিন স্মৃতি—যেখানে দারিদ্র্যের সমাধান না দিয়ে, গরিবদের বন্দি করে রাখা হয়েছিল। এটি শুধু প্রশাসনিক ব্যর্থতার গল্প নয়, বরং সামাজিক নৈতিকতারও পরীক্ষা। আজও এই কাহিনি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—দারিদ্র্যকে শাস্তি নয়, সহমর্মিতা ও ন্যায়ভিত্তিক সমাধান দিয়েই মোকাবিলা করতে হয়।
#MRKR
No comments:
Post a Comment