🏥⚖️ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একটি ওয়ার্ডের এই চিত্র বাংলাদেশের সরকারি হাসপাতালের পরিবেশ বোঝার জন্য যথেষ্ট।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা কখনও নাগরিক বান্ধব হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয় নাই। বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ খুবই কম। সেই বরাদ্দের বড় একটি অংশ দুর্নীতিবাজদের পকেটে চলে যায়। স্বাস্থ্য বাজেটে বরাদ্দ জিডিপির এক শতাংশের কম, অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জিডিপির ন্যূনতম ৫% বরাদ্দের সুপারিশ করে। বাংলাদেশের ডাক্তার-রোগী অনুপাত প্রায় ১:১৫৮১, যেখানে WHO নির্ধারিত অনুপাত কমপক্ষে ১::১০০০।
৫৪ বছরেও দেশে একটি দক্ষ স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা সম্ভব হয় নাই। অধিদপ্তর ও মন্ত্রনালয়ের মাধ্যমে প্রশাসনের কর্তৃত্বে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা দায়সারা গোছে পরিচালিত হচ্ছে।
🏥 প্রাইভেট সিন্ডিকেটের প্রভাব
বাংলাদেশে বিদ্যমান স্বাস্থ্যব্যবস্থায় একটি বড় সমস্যা হলো প্রাইভেট হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ওষুধ কোম্পানি ঘিরে তৈরি হওয়া অস্বচ্ছ সিন্ডিকেট। এই চক্র চিকিৎসা খাতকে বাজারভিত্তিক ব্যবসায় পরিণত করেছে। অনেক প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা ব্যয় সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে, অথচ মানসম্পন্ন সেবার নিশ্চয়তা নেই। ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে অপ্রয়োজনীয় টেস্ট করানো ও ওষুধ কোম্পানির প্রভাবে প্রেসক্রিপশন নির্ধারণ—এসব কার্যক্রম রোগীর চিকিৎসা অহেতুক ব্যয় বাড়িয়ে দেয়। একজন চিকিৎসক প্রায়শই এই সিন্ডিকেটের চাপের ভেতরে কাজ করতে বাধ্য হন, যা তাদের পেশাগত স্বাধীনতাকে সীমিত করে। হাতে গোনা কিছু চিকিৎসক স্বেচ্ছায় এই চক্রের অংশ হলেও এর মূল নিয়ন্ত্রণ বেসরকারি ব্যবসায়ী ও করপোরেট মালিকদের হাতে। এই সিন্ডিকেট ভাঙতে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ, স্বচ্ছতা ও কঠোর আইন প্রয়োগ অপরিহার্য।
👩⚕️ গ্রামীণ স্বাস্থ্য সেবার বাস্তবতা:
গ্রামে নবীন চিকিৎসকরা কাজ করতে অনিচ্ছুক, পেছনে প্রধান কারণ নিরাপত্তাহীনতা ও অবকাঠামোগত দুর্বলতা। নিরাপদ কর্মস্থল ও নিরাপদ বসবাসের সুযোগ না থাকলে কিংবা গ্রামে হাতুড়ে চিকিৎসকের রাজত্ব চলতে থাকলে একজন তরুণ চিকিৎসকের জন্য সেবা দেওয়ার মনোবল হারিয়ে ফেলে। ফলে গ্রামীণ স্বাস্থ্যব্যবস্থা ক্রমাগত দুর্বল হয়ে পড়ছে।
⚠️ হাতুড়ে চিকিৎসায় নির্ভরতা
দেশের স্বাস্থ্য সংকটকে পুঁজি করে গ্রামেগঞ্জে লাখো হাতুড়ে চিকিৎসক “চিকিৎসা” দিচ্ছে। নির্বিচারে আ্যন্টবায়োটিক ব্যবহারের কারণে ইতিমধ্যেই অনেক জীবাণু প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। ডেঙ্গু রোগীর মতো ঝুঁকিপূর্ণ ক্ষেত্রে ব্যথানাশক ও স্টেরয়েড দিয়ে চিকিৎসা দিচ্ছে তারা, যা কার্যত মৃত্যুদণ্ডের মতো পরামর্শ।
এছাড়াও প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শহরের অলিগলিতে মুদি দোকানের মতো ঔষধের দোকান গড়ে উঠেছে। যেখানে হাত বাড়ালেই যে কোন ঔষধ কেনার সুযোগ রয়েছে। এসব দোকানে অনেক ক্ষেত্রে দোকানদার চিকিৎসকের ভূমিকা পালন করে।
অপচিকিৎসার এই দুঃসহ চিত্র জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। অথচ এদের দমন করার দায়িত্ব যাদের, সেই নীতিনির্ধারকরা তা না করে বরং চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে দোষারোপ করেই দায়মুক্তি নিতে অভ্যস্ত।
🧭 দায় কার?
সরকারি হাসপাতালে রোগীর সংখ্যার তুলনায় অবকাঠামো ও জনবল মারাত্মকভাবে অপ্রতুল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় একশো শয্যার কৈন সরকারি হাসপাতালে তিনশো থেকে পাঁচশো রোগী চিকিৎসা নিচ্ছে—এ দৃশ্য অস্বাভাবিক হলেও আমাদের দেশে এটি প্রতিদিনের বাস্তবতা। ফ্লোরে শুয়ে চিকিৎসা নেওয়া রোগী বা অস্বাস্থ্যকর বাথরুম–এসব অব্যবস্থাপনার দায় প্রায়শই ডাক্তারদের ঘাড়ে চাপানো হয়।
সরকারি হাসপাতালের আউটডোরে একজন চিকিৎসক রোগীকে সঠিক পরামর্শ দেয়ার মতো পর্যাপ্ত সময় পান না বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই।
অপরদিকে বেসরকারি খাতে গড়ে তোলা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সিন্ডিকেট ও বানিজ্যিকরণের কারণে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে সেই সেবা। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ একজন করা চিকিৎসককে এই চক্রের মধ্যে থেকেই সেবা প্রদান করতে হয়।
দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বিদ্যমান প্রায় সব সমস্যার মূল কারণ কাঠামোগত ও নীতিগত সীমাবদ্ধতা।
বাংলাদেশে স্বাস্থ্য সংকটের দায় এককভাবে চিকিৎসকদের ওপর চাপানো অন্যায্য। প্রকৃত দায় সরকারের নীতিনির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ব্যর্থতায়। স্বাস্থ্যখাতের আমূল সংস্কার না করে, কিংবা হাতুড়ে চিকিৎসা নিয়ন্ত্রণ এবং সিন্ডিকেট ভাঙার উদ্যোগ না নিয়ে কেবল ডাক্তারদের দোষারোপ করলে কোনো সমাধান আসবে না।
🎭 নীতিনির্ধারক ও দ্বৈত আচরণ
এখানে সবচেয়ে বড় বৈপরীত্য হলো—নীতিনির্ধারক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিজেরা বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নেন, কিন্তু দেশের জনগণকে দুর্বল ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করতে বাধ্য করেন। নেতারা মাঝে মাঝে বক্তৃতায় সস্তা নীতিবাক্য শোনালেও বাস্তবে স্বাস্থ্যব্যবস্থা সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন না। তাদের শিক্ষা, চিকিৎসা, এমনকি কেনাকাটাও বিদেশমুখী হওয়ায় দেশের অভ্যন্তরীণ সেবা খাত উন্নয়নের চাপ তাদের ওপর পড়ে না।
🔑 সংস্কারের পথ
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে সংস্কার করতে হলে কয়েকটি পদক্ষেপ জরুরি:
➡️প্রাইভেট খাত ও ওষুধ কোম্পানির স্বার্থকেন্দ্রিক প্রভাব থেকে চিকিৎসা খাত মুক্ত করা।
➡️ যথাযথ মনিটরিং করে ঔষধ ও পরীক্ষার মান নিশ্চিত এবং যৌক্তিক দাম নির্ধারণ করা।
➡️সরকারি হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত বেড, ওষুধ ও জনবল নিশ্চিত করা।
➡️ দুর্নীতিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রুত ও দৃশ্যমান আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।
➡️গ্রামীণ এলাকায় চিকিৎসকদের নিরাপত্তা ও কর্মপরিবেশ উন্নত করা।
➡️ হাতুড়ে চিকিৎসা দমন ও বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা নিশ্চিতকরণ।
➡️ফার্মাসিস্ট ছাড়া লাইসেন্স বিহীন ঔষধের দোকান বন্ধ করা।
➡️নীতিনির্ধারকদের দেশেই চিকিৎসা নিতে বাধ্য করা, যাতে ব্যবস্থার উন্নয়ন অনিবার্য হয়।
➡️সার্বজনীন স্বাস্থ্য বীমা চালু করতে হবে।
✅ বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা আজ একটি জটিল সংকটের ভেতর। হাতুড়ে চিকিৎসক, প্রাইভেট সিন্ডিকেট, অব্যবস্থাপনা ও নীতিনির্ধারকদের উদাসীনতা মিলে সাধারণ মানুষকে প্রতিনিয়ত বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। ডাক্তারদের এককভাবে দায়ী করার সংস্কৃতি এই বাস্তবতাকে আড়াল করে। অথচ আমূল সংস্কার, কার্যকর নীতি বাস্তবায়ন ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার মাধ্যমেই এটি সমাধান করা যায়।
জনগণকে নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন, রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও নীতিনির্ধারকদের প্রশ্ন করে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
সচেতনতা সৃষ্টি ও সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে সিভিল সোসাইটি ও পেশাজীবী সংগঠনকে ভূমিকা পালন করতে হবে।
#MRKR