🐟 ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ, যার জীবনচক্র এক দীর্ঘ ও চমকপ্রদ ভ্রমণ কাহিনী। ইলিশের জীবন শুরু হয় নদীর মিঠে পানিতে। প্রজননের মৌসুমে—সাধারণত আগস্ট থেকে অক্টোবর এবং আংশিকভাবে জানুয়ারি–ফেব্রুয়ারিতে—পূর্ণবয়স্ক মা ও বাবা ইলিশ সমুদ্রের লোনা জল থেকে বিপরীত স্রোত ভেঙে নদীর উজানে উঠে আসে। তাদের এই দীর্ঘ যাত্রা কয়েকশ কিলোমিটার হতে পারে, এবং পথে থাকে নানা বাধা—প্রবাহের তীব্রতা, শিকারি মাছ, ডলফিন, এমনকি মানুষের জাল।
নদীর অক্সিজেনসমৃদ্ধ, অপেক্ষাকৃত ঠান্ডা ও পলিমিশ্রিত জলে মা ইলিশ ডিম ছাড়ে। একটি পূর্ণবয়স্ক মা ইলিশ এক মৌসুমে গড়ে ১.৫ থেকে ২ মিলিয়ন ডিম দিতে পারে। ডিমগুলো খুবই নাজুক, এবং ২৩–২৬ ঘণ্টার মধ্যে ফুটে ছোট লার্ভা বের হয়। এই লার্ভাগুলো প্রথমে নদীর শান্ত, পুষ্টিকর অংশে থাকে, যেখানে প্রচুর প্ল্যাঙ্কটন ও ক্ষুদ্র জীব তাদের খাবার সরবরাহ করে।
প্রথম ৩–৪ সপ্তাহে এরা দ্রুত বেড়ে জুভেনাইল বা কিশোর ইলিশে পরিণত হয়, যাকে বাংলাদেশে “জাটকা” বলা হয়। সাধারণত ১৫–২০ সেন্টিমিটার লম্বা হলে তারা নদীর স্রোতের টানে ধীরে ধীরে সমুদ্রের দিকে নেমে যায়। সমুদ্রে পৌঁছে তারা পরবর্তী ১–২ বছর কাটায়, যেখানে প্রচুর খাদ্য পেয়ে পূর্ণবয়স্ক আকার ধারণ করে (গড়ে ৩০–৪৫ সেন্টিমিটার)।
প্রজননের সময় এলে তাদের শরীরে শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন ঘটে—যেমন গোনাড বা প্রজনন অঙ্গের বৃদ্ধি, শক্তি ও চর্বি সঞ্চয়, এবং নদীমুখ চিনে নেওয়ার ক্ষমতা বৃদ্ধি। তখন তারা জন্মস্থানের দিকেই ফিরে আসে, যা হোমিং ইনস্টিংক্ট নামে পরিচিত। এটি এক ধরনের অ্যানাড্রোমাস (anadromous) আচরণ, যেখানে মাছ লোনা জল থেকে মিঠে জলে ফিরে এসে প্রজনন করে।
এই যাত্রা সম্পন্ন করে তারা আবার ডিম ছাড়ে, আর চক্রটি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে অব্যাহত থাকে।
🌍 ইলিশের প্রজাতি ও বিস্তৃতি
বিশ্বে #Hilsa গণের অন্তর্ভুক্ত প্রধান প্রজাতিগুলোর মধ্যে রয়েছে—Tenualosa ilisha, Tenualosa toli, Tenualosa reevesii এবং Hilsa kelee।
➡️Tenualosa ilisha: এটিএক ধরনের শ্যাড (shad), যা হেরিং পরিবারের (Clupeidae) অন্তর্গত। বাংলাদেশের পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ও উপকূলীয় সাগর; এছাড়া ভারত, পাকিস্তান, মায়ানমার, কুয়েত, ওমান ও ইরানের জলসীমায় পাওয়া যায়।
➡️Tenualosa toli: দক্ষিণ চীন সাগর ও আশপাশের উপকূল—ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং থাইল্যান্ডে বেশি দেখা যায়।
➡️Tenualosa reevesii: চীনের পূর্ব উপকূল, ইয়াংজি নদীর মোহনা এবং কোরিয়ার উপকূলীয় জলসীমায় বাস করে।
➡️Hilsa kelee: আরব সাগর, পারস্য উপসাগর ও ইরান, ইরাক, কুয়েত, ওমান, পাকিস্তানের উপকূলে পাওয়া যায়; আকারে তুলনামূলক ছোট এবং স্বাদে ভিন্ন।
📊 বিশ্বে ইলিশের উৎপাদন:
প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী ইলিশের উৎপাদন প্রায় ৫.৮৩ লাখ থেকে ৭.২ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে বাংলাদেশ একাই উৎপাদন করে প্রায় ৫.৬৫ থেকে ৫.৭১ লাখ মেট্রিক টন, যা মোট উৎপাদনের দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি। বাকিটা ভারত, মায়ানমার, পাকিস্তান, ইরানসহ অন্যান্য দেশ থেকে আসে। বাংলাদেশের ইলিশ স্বাদে ও গুণে বিশ্বে অনন্য, যার পেছনে নদীর পলি, বিশেষ জলপ্রবাহ এবং খাদ্য উপাদানের বড় ভূমিকা রয়েছে।
ইলিশের এই জীবনচক্র ও বিস্তৃত ভৌগোলিক উপস্থিতি শুধু প্রাকৃতিক বিস্ময়ের গল্প নয়—এটি মানুষের খাদ্যসংস্কৃতি, অর্থনীতি এবং নদী-সাগরের সংযোগ রক্ষারও প্রতীক।
#MRKR